প্রিয়নবী আক্বা ও মাওলা হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বংশধর ও আহলে বায়তে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) একই। এটা অধিকাংশ ইমামগণের অভিমত।
আহলে বায়তে রাসুল বলতে প্রিয়নবী হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর প্রিয়ভাজন তথা নিকটাত্মীয়গণকে বুঝানো হয়।
নবীয়ে দোজাঁহা রাহমাতুল্লিল আলামীনের নিকটাত্মীয় প্রসঙ্গে পবিত্র ক্বোরআনুল হাকীমে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন- “হে হাবিব! আপনি বলে দিন, আমি (রাসূলুল্লাহ) দ্বীন প্রচারের জন্যে তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না; কিন্তু (তোমাদের কাছে আমার) নিকটাত্মীয়দের ভালোবাসা চাই আর যে কেউ একটি সৎকাজ (যেমন তাঁদেরকে ভালোবাসা) করবে, আমি তাঁদের সৎকাজের সওয়ার বৃদ্ধি করে দিব।” [সূরা শূরা, আয়াত ২৩।]
বিশ্ব বিখ্যাত মুফাস্সির হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, এ আয়াত শরিফে ‘হাসানাহ্’(পুণ্যময় কাজ) বলতে ‘আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম’র ভালোবাসাকে বুঝানো হয়েছে এবং তাঁদের ভালোবাসার সওয়াবকে আল্লাহ তায়ালা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিবেন।
উল্লিখিত আয়াত শরিফ অবতীর্ণ হবার পর সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে প্রশ্ন জাগে যে, কাদের প্রতি ভালোবাসা আবশ্যক।
এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা থেকে একটি হাদিস শরিফ বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁদেরকে ভালোবাসা আমাদের উপর ওয়াজিব, এঁরা কারা? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তাঁরা হলেন-হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং তাঁদের বংশধরগণ।
[সূত্রঃ ইমাম ইবন আব্বাস,তানভিরুল মুকবাস (তাফসিরে ইবনে আব্বাস), দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, পৃ.৫০৮।]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাঁরা হলেন হযরত আলী, হযরত ফাতিমা এবং তাঁদের সন্তানগণ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।
[সূত্রঃ ইমাম রাজি, মাফাতিহুল গাইব, দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরবি, বৈরুত, ৩য় সংস্ককরণ,১৪২০ হি, খ. ২৭, পৃ. ৫৯৫; ইমাম সুয়ূতি, আদ-দুররুল মনসূর, দারুল ফিকর, বৈরুত, খ.৭,পৃ.৩৪৮।]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত সায়ীদ বিন জুবাইর এবং হযরত আমর বিন শুয়াইব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, এখানে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আহলে বায়ত (রাঃ) এঁর ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।
[সূত্রঃ কাজী সানাউল্লাহ পানিপথি, তাফসীরে মাযহারি, মাকতাবাতু রশীদিয়্যাহ, পাকিস্থান, প্র.১৪১২হি., খ. ৮, পৃ. ৩৩৮।]
তাছাড়া মাওলা আলী (রাঃ)কে ভালাবাসা স্বয়ং রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার নামান্তর।
আহলে বাইতের পরিচয় প্রদানে বহু হাদিস শরীফ রয়েছে। যেমন-
عن اُمِّ سَلْمَةَ رضى الله عنها انَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم جَمَعَ فاطمة وَحسَنًا وحيسنًا رضى الله تعالى عنهم ثُمَّ اَدْخَلَهُمْ تَحْتَ ثوبه- ثُمَّ قَالَ اللُهُّمَّ هَؤُلَاءِ اَهْلُ بَيْتِىْ- (طبرانى)
হযরত উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হতে বর্ণিত, একদিন নবী করীম (সাঃ) হযরত ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমকে একত্রিত করেছেন এবং তাদেরকে একটি কাপড়ে আবৃত করে নিলেন। অতঃপর বললেন- হে আল্লাহ্ এরা আমার আহলে বায়ত।
[সূত্রঃ তাবারানী: আল্ মুজামুল কবির, হাদীস- ২৬৬৩।]
অপর হাদীসে উল্লেখ আছে- হযরত সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন, যখন ‘মুবাহালা (একে অপরকে অভিসম্পাৎ করা) এর আয়াত ‘‘আপনি বলে দিন, এসো! আমরা আমাদের সন্তানদের ডাকছি, আর তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে ডাক।’’ নাযীল হল তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আলী, ফাতিমা, হাসান-হেসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমকে ডাকলেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ্ এরা আমার পরিবারবর্গ তথা আহলে বায়ত।
[সূত্রঃ মুসলিম শরীফ।]
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন “(হে আহলে বায়েত) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে, তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান।”
[সূরা আহযাব ৩৩)
হযরত সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
لَمَّا نَزَلَتْ هَذِهِ الْآيَةُ {نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ} ، دَعَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلِيًّا وَفَاطِمَةَ وَحَسَنًا وَحُسَيْنًا فَقَالَ: ” اللهُمَّ هَؤُلَاءِ أَهْلِي ”
“যখন এ পবিত্র আয়াত অবতীর্ণ হল যে, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ডাকি আর তেমরা তোমরা তোমাদেও সন্তানদেরকে ডাকো। তখন রাসূলে করীম মাওলা আলী, মা ফাতিমা, ইমাম হাসান ও হোসাইন (রা) কে একত্রে ডেকে বলেন, হে আল্লাহ, এঁরাই আমার আহলে বায়েত।”
( ইমাম হাকিম, আল-মুস্তাদরাক, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১ম সংস্করণ,১৪১১হি, বৈরুত, খ.৩, পৃ.১৬৩, হা.নং-৪৭১৯; ইমাম বায়হাকি, আস-সুনানুল কুবরা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ৩য় সংস্করণ,১৪২৪হি. খ.৭, পৃ.১০১, হা.নং-১৩৩৯২)
উল্লিখিত আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, “আহলে বায়তগণ” সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ও পাক। কারণ আল্লাহ তায়ালা যা চান, তাই হয়।
যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন-
فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ
অর্থাৎঃ “তিনি যা চান, তাই করেন।” [সূরা বুরুজ, আয়াত ১৬।] আল্লাহ তায়ালা যেহেতু “আহলে বায়ত” কে পবিত্র করতে চান, সেহেতু তাঁরা পুত:পবিত্র।
মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু “আহলে বায়ত”র অন্তর্ভুক্ত। তিনি আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।
আম্মা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন-একদা রাসূলে করীম (সাঃ) ভোরে কালো ইয়ামেনী চাদর গায়ে দিয়ে বের হলেন। অত:পর হযরত হাসান (রাঃ) তাঁর কাছে আসলেন, তিনি হাসান (রাঃ)কে চাদরে প্রবেশ করালেন। তারপর ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসলে, তাঁকেও তিনি চাদরাবৃত করেন। এরপর হযরত মা ফাতেমাতুয যুহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আসলে, তাঁকেও তিনি স্বীয় চাদরে প্রবেশ করান। সর্বশেষ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসলে, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকেও স্বীয় চাদরে প্রবেশ করিয়ে কুরআন মাজীদের আয়াত তেয়াওয়াত করেন- {إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا}
[সূত্রঃ ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ (মুসলিম শরীফ), দারুল জিয়াল,বৈরুত, খ.৭, পৃ. ১৩০, হা.নং-৬৪১৪।]
অন্য বর্ণনায় হযরত উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন- “রাসূলে করীম (সাঃ) হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন, হযরত মা ফাতেমাতুয যোহরা এবং হযরত আলী (রাঃ) কে চাদরাবৃত করে, ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ, এরা হল আমার পবিরাববর্গ , হে আল্লাহ, আপনি তাঁদের অপবিত্রতা দূর করে, তাঁদেরকে পবিত্রই করে দেন।”
[সূত্রঃ ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান (তিরমিযি শরীফ), মাকতাবাতু মুস্তাফা, মিশর, ২ সংস্করণ,১৩৯৫ হি., খ.৫, পৃ.৬৯৯, হা.নং-৩৮৭১।]
অতএব কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত হল যে, হযরত মা ফাতিমা (রাঃ), মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তাঁদের দুই পুত্র পুত:পবিত্র, আর তাঁদের বংশধরেরা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঁর বংশধর বা আলে রাসুল।
এভাবে অসংখ্য হাদীসে পাকে আহলে বায়তে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এঁর পরিচয় বর্ণনা রয়েছে। যাদের পবিত্রতার ব্যাপারে ক্বোরআনে পাকে বর্ণিত রয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে একই ভাবে একটি হাদীসে পাকেও বর্ণনা পাওয়া যায়- হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আল্লাহর বাণী ‘হে নবী পরিবার! নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পাক-পবিত্র করতে।
[সূরা আহযাব] এ সম্পর্কে বলেন আয়তটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এই পাঁচ মনীষী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।
[সূত্রঃ তাবরানী আল্ মু’জামুস্ সগীর, হাদীস নং ৩২৫।]
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ বিন ইসমাইল সানআনি আলাইহির রাহমাহ বলেন- “হযরত ফাতেমা (রাঃ) এঁর সূত্রে মাওলা আলী (রাঃ) এঁর সন্তানগণ রাসূলে করীম (সাঃ) এর প্রকৃত আওলাদ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর জন্য খাস। এটাকে ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ রাসূলে করীম (সাঃ)র বৈশিষ্ঠ্য হিসেবে গণ্য করেছেন। আর তাঁরা হযরত আলী (রাঃ)’রও সন্তান। কেননা তাঁরা রাসূলে করীম (সাঃ) ও মাওলা আলী (রাঃ) উভয়ের উত্তর পুরুষ। এটি হল হযরত মা ফাতেমা (রাঃ) ও মাওলা আলী (রাঃ) এর মর্যাদা, যা তাঁদের জন্যই নির্ধারিত।”
[সূত্রঃ মুহাম্মদ বিন ইসমাইল সানআনি, আত-তায়সীর শরহুল জামিইস সগীর, মাকতাবাতু দারিস সালাম, বিয়াদ, ১ম সংস্করণ, ১৪৩২হি., খ.৩, পৃ.২৯৩, হা.নং-১৭১১।]
প্রতীয়মান হলো যে, আহলে বায়ত হলেন, শেরে খোদা হযরত আলী, হযরত মা-ফাতিমা, হযরত ইমাম হাসান-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও তাঁদের সন্তানগণ। তাই আহলে বায়ত তথা নবী বংশধরদের ভালবাসা, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, অন্তরে ভক্তি শ্রদ্ধা রাখা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ওয়াজিব।
এই পোষ্টটি আহলে বায়েতের ভালোবাসার্থে শেয়ার করে সওয়া হাসিল করুন ।