যে সব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না
হযরত সায়্যিদুনা আবু হুরায়রা ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ থেকে বর্ণিত, তাজেদারে মদীনা হযরত মুহাম্মদ ﷺ ইরশাদ করেন, “যে রোযাদার ভুলবশতঃ পানাহার করেছে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ, তাকে আল্লাহ তাআলা পানাহার করিয়েছে। (সহীহ বোখারী, খন্ড-১ম, পৃ-৬৩৬, হাদীস নং-১৯৩৩)
১. ভুলবশতঃ আহার করলে, পান করলে কিংবা স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভাঙ্গে না, চাই ওই রোযা ফরয হোক কিংবা নফল। (আদ-দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
২. কোন রোযাদারকে এসব কাজে করতে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। যদি আপনি স্মরণ করিয়ে না দেন তবে গুনাহগার হবেন। হাঁ, যদি রোযাদার খুবই দুর্বল হয়, কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিলে পানাহার ছেড়ে দেবে, যার ফলে তার দূর্বলতা এতোই বেড়ে যাবে যে, তার জন্য রোযা রাখা কঠিন হয়ে যাবে, আর পানাহার করে নিলে রোযাও ভালোমতে পূর্ণ করে নেবে এবং অন্যান্য ইবাদতও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, (যেহেতু সে ভুলে পানাহার করছে, এ কারণে তার রোযাও পূর্ণ হয়ে যাবে।) এমতাবস্থায়, স্মরণ করিয়ে না দেয়াই উত্তম। কোন কোন মাশাইখ কিরাম ﺭَﺣْﻤَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ বলেন, “যুবককে দেখলে স্মরণ করিয়ে দেবেন, আর বৃদ্ধকে দেখলে স্মরণ করিয়ে না দিলেও ক্ষতি নেই।” কারণ, যুবক বেশিরভাগই শক্তিশালী হয়ে থাকে। আর বুড়ো হয় বেশিরভাগ দুর্বল। সুতরাং বিধান হচ্ছে এ যে, যৌবন ও বার্ধক্যের কোন কথা এখানে নেই, বরং সক্ষম হওয়া ও দুর্বলতাই এখানে বিবেচ্য। অতএব যুবকও যদি এ পরিমাণ দূর্বল হয়,তবে স্মরণ করিয়ে না দেয়ার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই। আর বয়স্ক অথচ যদি শক্তিশালী হয় তবে স্মরণ করিয়ে দেয়া ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৫)
৩. রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও যদি মাছি কিংবা ধুলিবালি কিংবা ধোঁয়া কণ্ঠনালী দিয়ে ভিতরে চলে যায়, তাহলে রোযা ভঙ্গ হয় না, চাই ধুলি আটার হোক, যা চাক্কি পেষণ কিংবা আটা মেশিনে নেয়ার সময় উড়ে থাকে, চাই ফসলের ধুলি হোক, চাই বাতাসে মাটি উড়ে আসুক, কিংবা পশুর খুর ও পা থেকে আসুক। (আদ দুররুল মুখতার ও রদ্দুল মুহতার, খন্ড-০৩, পৃ-৩৬৬)
৪. অনুরূপভাবে, বাস কিংবা গাড়ির ধোঁয়া অথবা সেগুলোর কারণে ধুলি ওড়ে কণ্ঠনালীতে পৌঁছে, যদিও রোযাদার হবার কথা স্মরণ ছিলো, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না।
৫. যদি এমন হয় যে, বাতি জ্বলছে, আর সেটার ধোঁয়া নাকে প্রবেশ করেছে, তবু রোযা ভাঙ্গবে না। হাঁ, যদি লোবান কিংবা আগর বাতি জ্বলতে থাকে আর রোযার কথা মনে থাকা সত্ত্বেও মুখ সেটার নিকটে নিয়ে গিয়ে নাক দ্বারা ধোঁয়া টানে, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৬)
৬. শিঙ্গা লাগালো (*) কিংবা তেল অথবা সুরমা লাগালো, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না; যদিও তেল কিংবা সুরমার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভুত হয়, এমনকি যদি থুথুুর মধ্যে সুরমার রঙও দেখা যায়, তবুও রোযা ভাঙ্গবে না। (আল-জাওহারাতুন্ নাইয়ারাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৯)
* এটা ব্যথার চিকিৎসার একটা বিশেষ পদ্ধতি, যাতে ছিদ্র শিং ব্যথাগ্রস্ত স্থানে রেখে মুখ দিয়ে শরীরের দুষিত রক্ত টেনে বের করা হয়।
৭. গোসল করলে পানির শীতলতা, ঠান্ডা ভিতরে অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২৩০)
৮. কুলি করে পানি ফেলে দিলো। শুধু কিছুটা আর্দ্রতা মুখে অবশিষ্ট রয়ে গেলো, থুথুুর সাথে তা গিলে ফেলল, রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
৯. ঔষধ দাঁতে কাটলো, কণ্ঠনালীতে সেটার স্বাদ অনুভুত হলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১০. কানে পানি ঢুকে গেলে, রোযা ভঙ্গ হয় না, বরং খোদ্ পানি ঢাললেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১১. খড়কুটা দ্বারা কান চুলকালো, ফলে ওই খড়কুটার ময়লা লেগে গেলো, আর ওই খড়কুটাটি পুনরায় কানে দিলো। সে কয়েকবার এমন করলেও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১২. দাঁত কিংবা মুখে হালকা এমন কোন জিনিষ অজানাবশতঃ রয়ে গেলো, যা থুথুর সাথে নিজে নিজেই নিচে নেমে যায়। বাস্তবেও তা নেমে গেছে। তবুও রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
১৩. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে কণ্ঠনালী পর্যন্ত গেলে, কিন্তু কণ্ঠনালী অতিক্রম করে নিচে নামেনি। এমতাবস্থায় রোযা ভাঙ্গেনি। (ফতহুল কদীর, খন্ড-২য়, পৃ-২৫৭)
১৪. মাছি কণ্ঠনালীতে চলে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৫. ভুল করে খাবার খাচ্ছিলো। মনে হতেই লোকমা ফেলে দিলে কিংবা পানি পান করছিলো, স্মরণ হতেই মুখের পানি ফেলে দিলো। তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি মুখের ভিতরের লোকমা কিংবা পানি স্মরণ হওয়া সত্ত্বেও গিলে ফেলে
তবে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৬. সুবহে সাদিকের পূর্বে আহার কিংবা পান করছিলো, আর ভোর হতেই (অর্থাৎ সাহারীর সময়সীমা শেষ হতেই) মুখের ভিতরের সবকিছু ফেলে দিল, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না, আর যদি গিলে ফেলে তবে ভেঙ্গে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৩)
১৭. গীবত করলে রোযা ভাঙ্গবে না। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬২) যদিও গীবত জঘন্য কবীরা গুনাহ্। কুরআন মজীদে গীবত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘তা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার মতোই।’ আর হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, ‘গীবত যেনা থেকেও জঘন্যতর।’ (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩১, হাদীস নং-২৬) অবশ্য, গীবতের কারণে রোযার নূরানিয়্যাত শেষ হয়ে যায়। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-৬১১)
১৮. ‘জানাবত’ (অর্থাৎ গোসল ফরয হবার) অবস্থায় কারো ভোর হলো, বরং গোটা দিনই ‘জুনুব’ (অর্থাৎ গোসল বিহীন) রয়ে গেলো, তবুও রোযা ভাঙ্গেনি। (আদ দুররুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭২) কিন্তু এত দীর্ঘক্ষণ যাবত ইচ্ছাকৃতভাবে
(অর্থাৎ জেনে বুঝে) গোসল না করা, যাতে নামায কাযা হয়ে যায়, গুনাহ ও হারাম। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, “যে ঘরে ‘জুনুবী’ থাকে সে ঘরে রহমতের ফিরিশতা আসে না।” (বাহারে শরীয়ত, খন্ড-৫ম, পৃ-১১৬)
১৯. সরিষা কিংবা সরিষার সমান কোন জিনিষ চিবালে, আর থুথুর সাথে কণ্ঠনালী দিয়ে নিচে নেমে গেলে, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। কিন্তু যদি সেটার স্বাদ কণ্ঠনালীতে অনুভূত হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (ফতহুল কাদীর, খন্ড-২য়, পৃ- ২৫৯)
২০. থুথুু কিংবা কফ মুখে আসলে সেটা গিলে ফেললো, রোযা ভাঙ্গবে না।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)
২১. অনুরূপভাবে নাকে শ্লেষ্মা জমা হয়ে রইলো। তা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে টেনে গিলে ফেললেও রোযা ভাঙ্গবে না।
(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৭৩)
২২. রোযা অবস্থায় যদি নিজে নিজে কয়েকবার বমি এসে যায়। (চাই বালতি ভরে হোক)- এর কারণে রোযা ভাঙ্গে না।
(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)
২৩. যদি রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় (জেনে বুঝে) বমি করলো, আর যদি তা মুখ ভর্তি করে আসে, (মুখ ভর্তির সংজ্ঞা সামনে আসছে), তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯২)
২৪. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখভর্তি বমি হওয়ার ক্ষেত্রে ঐ সময় রোযা ভেঙ্গে যাবে যখন বমির সাথে খানা অথবা পানি বা হলুদ ধরনের তিক্ত ঝাঁঝালো পানি অথবা রক্ত আসে।
২৫. যদি বমিতে শুধু কফ বের হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৪)
২৬. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলো; কিন্তু সামান্য বমি আসলো, মুখ ভর্তি হয়ে আসেনি, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না।(দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)
২৭. মুখভর্তি অপেক্ষা কম বমি হলে মুখ থেকে ফিরে গেলো। কিংবা নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায়ও রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৯৩)
২৮. বিনা ইচ্ছায় মুখভর্তি বমি হয়ে গেলো রোযা ভাঙ্গবে না। অবশ্য, যদি তা থেকে একটা বুটের সমানও গিলে ফেলা হয়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এক বুটের পরিমাণের চেয়ে কম হলে রোযা ভাঙ্গবে না। (দুররে মুখতার, খন্ড-২য়, পৃ-৩৯২)
মুখভর্তি বমির অর্থ হচ্ছে- সেটা অনায়াসে চলে আসে, যা চেপে রাখা যায় না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-২০৪)
<<< সবাই শেয়ার করে অন্যদের জানিয়ে দিন >>>
মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামিন আসন্ন মাহে রমজানে আমাদের বেশি বেশি নেক আমল তৌফিক দান করুন। #আমীন।