ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানের অধিকার
পিতা-মাতা হলেন সন্তানের প্রথম অভিভাবক, প্রথম শিক্ষক। আর পরিবার তার প্রথম বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থেকে সে যা শিখবে, সেটার ওপর নির্ভর করবে তার ভবিষ্যত সুন্দর হওয়া না হওয়া। তাই এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। পিতা-মাতার অবহেলায় অধিকাংশ সন্তান সঠিকভাবে গড়ে উঠেনা। অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় তাদের জীবনবৃক্ষ। সন্তানের সুন্দর জীবন গঠনে তাই মা-বাবার সচেতনতা ও আন্তরিকতার বিকল্প নেই। সন্তানকে রক্ষা করার উপায় হলো, তার মাঝে বুদ্ধির উন্মেষ লক্ষ্য করা মাত্র উত্তমরূপে তাকে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করতে শুরু করবে। বুদ্ধির এ উন্মেষের সূচনা লাজুকতার প্রাথমিক প্রকাশের মাধ্যমে। কারণ, যখন সে লজ্জা পায়, সলাজ হয় এবং কোনো কিছু বর্জন করে, তা কেবল তার ওপর জ্ঞানের আলো পড়ার কারণেই করে। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এটি তার জন্য একটি উপহার এবং সুসংবাদতুল্য, যা স্বভাবের সুস্থতা ও হৃদয়ের স্বচ্ছতা প্রমাণ করে। এটি পরিণত বয়সে তার বুদ্ধির পূর্ণতারও ইঙ্গিত প্রদান করে। সুতরাং শিশুর লাজুকতাকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। বরং তাকে সুশিক্ষিত ও মার্জিতভাবে গড়ে তুলতে এ লাজুকতা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো উচিত। প্রতিপালনের প্রাথমিক অবস্থায় যদি শিশুর প্রতি অযত্ন ও অনাদর দেখানো হয়, তবে প্রায় ক্ষেত্রেই সে অসৎ স্বভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। মিথ্যুক, হিংসুক, নিন্দুক হিসেবে এবং অনর্থক কথা, অট্টহাসি, কূটচাল ও অশ্লীল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে বড় হয়। শিশুকে এসব বদ অভ্যাস থেকে বাঁচানো সম্ভব আদব বা শিষ্টাচার শেখানোর মাধ্যমে। তাকে পাঠাতে হবে দ্বীনি শিক্ষালয়ে। সেখানে সে কুরআন-হাদীস শিখবে। পূর্বসুরী বুযুর্গ ও মনীষীদের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী ও জীবনালেখ্য স¤পর্কে জানবে। এতে করে তার কচি, মনে নেককার ও মনীষীদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জন্ম নেবে। শিশুর কোনো সুন্দর আচরণ বা প্রশংসনীয় কাজ চোখে পড়লে, তার প্রশংসা করতে হবে। তাকে খুশি করার মতো কিছু পুরস্কার দিতে হবে। মানুষের সামনে করতে হবে তার প্রশংসা। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যখন সে কিছু করবে যখন প্রথমবারের মতো, তখন তা উপেক্ষা করতে হবে। গোপন রাখতে হবে; অন্যের সামনে প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষত বাচ্চাটিই যখন চাইবে সেটিকে গোপন রাখতে। অন্যের কাছ থেকে আড়াল করতে। যদি দ্বিতীয়বার এ কাজের পুনরাবৃত্তি করে, তবে তাকে গোপনেই শাসাতে হবে। বলে দিতে হবে, এমন কাজ তুমি দ্বিতীয়বার করা থেকে বিরত থাকবে। অন্যথায় মানুষের সামনে তোমাকে লজ্জা দেয়া হবে। তাকে শাসন করার সময় কখনো অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এতে করে তার পক্ষে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার শোনা এবং মন্দ বিশেষণ হজম করা সহনীয় হয়ে উঠবে। তার অন্তরে কথার প্রভাব হ্রাস পাবে। তার হৃদয়ে কথার প্রভাব যে কোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে। তাকে কেবল মাঝেমধ্যেই ভর্ৎসনা করা যাবে। মা তাকে বাবার ভয় দেখাবেন। মন্দ কাজ থেকে ধমকাবেন। প্রখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, জেনে রাখ, শিশু প্রতিপালন পদ্ধতি একটি অতি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। আর সন্তান তার পিতা-মাতার কাছে আমানত স্বরূপ। তার পবিত্র অন্তর অমূল্য মাণিক্য, যে কোনো নকশা বা ছবি থেকে যা মুক্ত। ফলে তা যে কোনো নকশা গ্রহণে প্রস্তুত এবং তাকে যার প্রতিই ধাবিত করা হবে সে দিকেই সে ধাবিত হয়। তাই তাকে ভালোয় অভ্যস্ত করা হলে, সুশিক্ষায় প্রতিপালন করলে, সেভাবেই সে গড়ে উঠবে। ইহকালে ও পরকালে সে সুখী হবে। তার নেকীতে তার পিতা-মাতা এবং তার প্রত্যেক শিক্ষক ও শিষ্টাচারদানকারীই অংশীদার হবে। পক্ষান্তরে তাকে খারাপে অভ্যস্ত করা হলে, তাকে পশুর ন্যায় অবহেলা করা হলে, সে হবে হতভাগ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এর দায় বর্তাবে তার কর্তা ও অভিভাবকের ওপর।
মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার কর্তব্যের ব্যাপারেও ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পন করেছেন। সন্তান হলো পিতা-মাতার কাছে প্রদত্ত আল্লাহর আমানত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের (তার সম্পদ ও সন্তানের); সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। অতএব আল্লাহর এ আমানত সম্পর্কে মাতা-পিতাকে সজাগ ও আরো বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। সন্তানদের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক খোরাকের প্রতিও নজর রাখতে হবে।
পিতা-মাতা নিজ সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্ববান কিংবা বেখবর নই বটে। তবে যথাযথ দায়িত্ববান নয়। আরও বাস্তব কথা হলো, আমরা নিজ দায়িত্ব স¤পর্কে পূর্ণ অবগত নই। কেউ হয়তো মহান আল্লাহর হুকুম মতো জীবন পরিচালনাই করি না আর যারা করি, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করণীয় স¤পর্কে অবগতই নই। তাই দেখা যায়,মাতা-পিতা শুধু সন্তানের দৈহিক চাহিদার তত্ত্বাবধান করে। তার আত্মিক চাহিদার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপও করে না। অথচ এর গুরুত্ব প্রথমোক্তটির চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। দৈহিক চাহিদাকে পরিতৃপ্তি দিতে পারে কেবল আত্মা। পক্ষান্তরে দৈহিক চাহিদার অপূর্ণতা সত্ত্বেও আত্মা পারে সুখী হতে। ইসলাম তাই শিশুর উভয় চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। পিতা-মাতাকে উভয় দিক তত্ত্বাবধান করতে নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছে। সন্তানকে আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ ও ঐশ্বর্যমন্ডিত করার বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও, যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাদেরকে আদব শিক্ষা দাও এবং ইলম শিখাও। পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি সন্তানকে আদর্শবান রূপে গড়ে না তুলতে পারে। শিশুকে মূলত ভালো-মন্দ উভয় চরিত্রের মিশ্রণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার পিতামাতাই তাকে ভালো-মন্দের যে কোনোটির দিকে ধাবিত করেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিটি নবজাতক তার স্বভাবজাত দ্বীন ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদী, নাসারা কিংবা অগ্নিপূজক হিসেবে গড়ে তোলে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সন্তানকে লালন-পালন করা ঈমানের অন্যতম দাবী। পিতা-মাতার উপর সন্তানদের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম।
১. কানে আযান দেয়া : সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া এবং বাম কানে একামত দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। এটি পিতা-মাতার উপর এজন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যে, শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছে দেয়া এবং ওত পেতে থাকা শয়তান যেন তার কোন ক্ষতি করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবূ রাফে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কানে আযান দিতে দেখেছি।
২. সুন্দর নাম রাখা : বাচ্চার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন।
৩. আক্বিকা করা : ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আকীকা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সন্তান ছেলে হলে দুটি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল দ্বারা আক্বীক্বা করবে। এ প্রসঙ্গে হযরত সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে।
৪. সদকা করা : ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সপ্তম দিবসে চুল কাটা এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকা করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতেমা বতুল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে ইরশাদ করেন, হে ফাতেমা ! তাঁর (হাসানের) মাথা মুন্ডন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকা কর। এছাড়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে খেজুর দিয়ে তাহনীক এবং বরকতের জন্য দোয়া করতেন।
৫. খাতনা করা : ছেলেদের খাতনা করানো একটি অন্যতম সুন্নাত। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান এবং হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে খাতনা করিয়েছেন।
৬. তাওহীদ ও রিসালত শিক্ষা দেয়া : শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর একত্ববাদ ও নবীর রিসালত শিক্ষা দিতে হবে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন, হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। যখন কোন কিছু চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সহযোগিতা চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সক্ষম হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে।
৭. কুরআনুল করিম শিক্ষা দান : ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। কেননা, কুরআন শিক্ষা করা ফরয। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়। অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের সন্তানকে কুরআন শরীফ নাজেরা পড়ায়, তার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর যে সন্তানকে হাফেজ বানাবে, তাকে হাশরের ময়দানে পূর্নিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল করে উঠানো হবে, এবং তার সন্তানকে বলা হবে পড়তে শুরু কর। সন্তান যখন একটি আয়াত পড়বে, তখন পিতার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এ ভাবে সমস্ত কুরআন শরীফ পড়া হবে এবং মাতা-পিতার মর্যাদাও শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
৮. নামায শিক্ষা দেয়া ও সালাত আদায়ে অভ্যস্ত করা :এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের নামাযের নির্দেশ দাও সাত বছর বয়সে। আর দশ বছর বয়সে নামাযের জন্য মৃদু প্রহার কর এবং শোয়ার স্থানে ভিন্নতা আনো।
৯. আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া : সন্তানদের আচরণ শিক্ষা দেয়া পিতা-মাতার উপর দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তভুক্ত। হযরত লুকমান আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানকে বললেন, আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সব চাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।
১০.আদর-স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া : সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা প্রিয়নবীর সুন্নাত। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান রাদি¦য়াল্লাহু আনহুকে চুম্বন দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় হযরত আকরা ইবনে হাবিস রাদিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমারতো দশটি সন্তান কিন্তু আমিতো কখনো আমার সন্তানদেরকে আদর-স্নেহ করিনি। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে অন্যের প্রতি রহম করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না।
১১. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া : সন্তানকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ফরজ । কারণ দ্বীনি ইলম জানা না থাকলে সে বিভ্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয।
১২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা :সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে হবে। হযরত উম্মে সালামা রাদ্বিয়ল্লাহু আনহা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি, এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে।
১৩. সক্ষম করে তোলা : সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়ল্লাহু আনহু বলেন, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন, তোমাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।
১৪. বিবাহ দেয়া এবং বিধবা ও তালাকপ্রাপ্তা কন্যাকে আশ্রয় দান: সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে বিবাহ দেয়া পিতার দায়িত্ব। সন্তান যখন যৌবনে পদার্পন করে তখন তার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটে, তখন সে নতুন কিছুর সন্ধানে উন্মুখ হয়। সে যেকোন সময় বিপদগামী হতে পারে। তাই পিতার একান্ত উচিৎ উপযুক্ত পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। বিবাহ মানুষকে পাপ কাজ হতে বিরত রাখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বিবাহ দৃষ্টিকে নিন্মগামী করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই পিতার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। কোন কারণে কন্যা যদি স্বামী কর্তৃক পরিত্যাক্তা হয় কিংবা বিধবা বা অসহায় হয়ে পড়ে, তখন পিতা সেই ভাগ্যাহতা কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, আশ্রয় ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে। কোন অবস্থাতেই পিতা তার ব্যাপারে বিমুখ হবে না। সন্তানের এ অধিকার পিতার নিকট প্রাপ্য।
১৫. কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালিত করা : পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে, কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করে তোলা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লাল বর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম।
১৬. সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা : রাসূলল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তাদের মাঝে ইনসাফ করো।
১৭. ইসলাম বিবর্জিত কাজ থেকে বিরত রাখা : ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে তাদেরকে বিরত না রাখলে এই সন্তানগণই কিয়ামাত দিবসে পিতা-মাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ইরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। অন্যথায় তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দাও। আমরা তাদের উভয়কে আমাদের পায়ের নীচে রাখব, যাতে তারা নিকৃষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯. দোয়া করা : পিতা-মাতা সন্তানদের জন্য দোয়া করতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহর নেক বান্দা তারাই যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন, যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। অপরপক্ষে সন্তানকে কোন অভিশাপ বা বদদোয়া করা মাতা-পিতার জন্য শোভনীয় নয়। এক ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট এসে নিজের এক পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল। তিনি বললেন, তাকে তুমি কোনরূপ বদদোয়া করেছ কি? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তবে তুমি তাকে নষ্ট করেছ।
পরিশেষে বলা যায়, সন্তান দম্পত্য জীবনের কাঙ্খিত ফসল। তাই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভের জন্য তাদেরকে যথাযথভাবে গড়ে তোলা বাবা-মা’র দায়িত্ব। যাতে সৎ সন্তান হিসাবে তারা পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের জন্য আমল জারী থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর নির্দেশ মতো সন্তান মানুষ করার তাওফীক দান করুন। আমিন! বিহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।