ইয়াযিদ সম্বন্ধে নবীজি (ﷺ)-র ভবিষ্যতবাণীঃ-
রাসূলে পাক (ﷺ)- ইয়াজিদ সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যতবাণী করেছেন। তার চরিত্র, দুষ্কর্ম, এমনকী তার বংশ পরিচয় সবকিছুই নবীজি (ﷺ)- বর্ণনা করে গেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি- কুরাইশদের কিছু যুবকদের হাতে আমার উম্মত ধ্বসং হবে। তখন মারওয়ান বললেন- এ সমস্ত যুবকদের প্রতি আল্লাহর লা’নত। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন- আমি যদি চাই তাহলে বলতে পারব তারা ওমুকের পুত্র ওমুক। (বুখারি হাদিস নং ৭০৫৮, মুসলিম হাদিস কিতাবুল ফিতান)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী আলাইহির রহমত উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন- নিশ্চয়ই এজিদই হল সর্বপ্রথম যুবক শাসক। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এর বক্তব্য ইহাই প্রমাণ করে। তিনি অন্য হাদিসে ৬০ হিজরির শুরু এবং যুবক শাসন কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ এজিদই সর্বপ্রথম বিভিন্ন শহরের বয়স্ক শাসকদের বরখাস্ত করে সে পদে তার নিজগোত্রীয় যুবকদের নিযুক্ত করে। (ফাতহুল বারী ১৩/০৩)
ইয়াযিদের জন্ম-মৃত্যুঃ-
ইয়াযিদের জন্ম তারিখ সম্বন্ধে কিছুটা মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি আলাইহির রহমত ‘তারিখুল খোলাফা’ গ্রন্থে (আরবি) পৃ-১৭ বলেছেন- ইয়াযিত বিন মুয়াবিয়া হিজরি ২৫ অথবা ২৬ সনে জন্মগ্রহণ করে। আর মৃত্যু প্রসঙ্গে হাফিজ ইবনে কাছির বর্ণনা করেন,এজিদ ৬৪ হিজরি সনের ১৪ই রবিউল আউয়াল তারিখে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৫ বছর অথবা ৩৮ বছর। তার দুঃশাসন ছিল ৩ বছর ৬ মাস। তার মৃত্যুর পরেই যুদ্ধ , ফিতনা-ফাসাদের অবসান ঘটে (শেষ হয়)। (বেদায়া ওয়ান নেহায়া- ৬৩৬ পৃষ্ঠা)
ইয়াজিদের স্বভাব চরিত্রঃ-
আমিরে মুয়াবিয়া (রাঃ) পর ৬০ হিজরিতে সে ক্ষমতা দখল করে। অতঃপর ৬৪ হিজরিতে তার অকাল মৃত্যু হয়। তার শাসনকাল ছিল মাত্র ৩ বছর ৬ মাস। কিন্তু এ সামান্য সময়ের শাসনকাল পুরোটাই ছিল যুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচারে ভরপুর । ক্ষমতা দখলের পূর্বেও সে ছিল একজন বদচরিত্রের অধিকারী।
হাফিজ ইবনে কাছির বলেন, ক্ষমতা দখলের পূর্বেও সে খেল-তামাশা, ঠাট্টা, মশকারি ও অহেতুক কাজে লিপ্ত থাকতো। (বেদায়া- ৮/২২)
আররাদ্দু আলাল মুতাআসসিব কিতাবের ৬৪ পৃষ্ঠা আছে সে মদপান করতো বাদ্যযন্ত্র বাজাতো, কুকুরের সাথে খেলা করতো।
আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থের ৮/২১৬ পৃষ্ঠায় আছে,আল্লাহর কসম ! সে মদপান করতো এবং নেশাগ্রস্থ থাকতো, এমনিভাবে নামাযের ওয়াক্ত চলে যেত।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও নিষ্ঠুরতাঃ –
হাফিজ ইবনে কাছিরের বর্ণনা, অতঃপর মুসরিফ বিন উকবাহ এজিদের নির্দেশক্রমে মদিনা শরীফকে তিন দিনের জন্য বৈধ ঘোষণা করল। এজন্য আল্লাহ তাকে ভাল প্রতিদান দিবেন না। সে অসংখ্য সম্মানিত সাহাবি হাফিজে কুরআনদেরকে শহিদ করেছিল। তাদের মাল সম্পদ লুণ্ঠন করে ছিল। অনেক মহিলাদের উপর পতিত হয়েছিল। মারাত্মক ফাসাদ তৈরি করেছিল। এ ইতিহাস অনেকেই বর্ণনা করেছেন। (বেদায়া-৬২০ পৃষ্ঠা)
সে আক্রমণ অনেক সাহাবি সহ অসংখ্য লোক শহিদ হয়েছিলেন। মদিনা শরীফকে লুঠতরাজের জন্য বৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে এক হাজার কুমারি নারী তাদের ইজ্জত হারিয়েছিলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহ রাজিউন। (তারিখুল খোলাফা- ১৬৬ পৃষ্ঠা)
ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি আলাইহির রহমত ‘তারিখুল খোলাফা’ গ্রন্থের ১৬৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন,ইরাকবাসী ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহু এর কাছে অসংখ্য দূত মারফত পত্রাদি প্রেরণ করে তাকে সেখানে আসতে আহবান করে। অতঃপর হোসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহু জিলহজ্বের ১০ তারিখ মক্কাশরীফ থেকে ইরাক পথে রওয়ানা দেন। তার সাথে ছিলেন পরিবারের কিছু পুরুষ, মহিলা ও শিশুগণ। তখন এজিদ ইরাকের গভর্ণর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে পত্র মারফত নির্দেশ দেয় হোসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহুকে শহিদ করার জন্য।
আল্লামা সিবতু ইবনুল জাওযী গ্রন্থে বর্ণনা করেন, এজিদের ব্যাপারে সবগুলো বর্ণনা যাচাই বাছাই করার পর প্রসিদ্ধ মত হল যে, ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু আনহু এর শির মোবারক শামে পৌছার পর যখন এজিদের সামনে রাখা হল তখন সে শাম বাসীদের একত্রিত করল। অতঃপর তার হাতে লাঠি দ্বারা শির মোবারকের উপর আঘাত করতে লাগল। এবং ইবনে যুবারীর কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল। ‘হায় বদরে নিহত আমার মুরুব্বিগণ যদি এ অবস্থা দেখত। খাযরাজ গোত্রের তলওয়ার গুলো আজ আক্রমণ করছে। (তাযকিরাতুল খাওয়াস ২৬১)
ইয়াযিদের সম্পর্কে উলামা ও মুহাদ্দিসগনের বক্তব্যঃ-
ইমাম কুরতুবির বক্তব্য: ইমাম কুরতুবি বর্ণনা করেছেন- নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস ‘কুরাইশদের কিছু যুবকদের হাতে আমার উম্মত ধ্বংস হবে।’এই হাদিস উল্লেখ করার পর ইমাম কুরতুবি বলেন- উক্ত হাদিসে ইঙ্গিত পূর্ণ ব্যক্তিগণ হলেন এজিদ ইবনে মুয়াবিয়া, উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ এবং বনী উমাইয়ার ঐ সমস্ত যুবকগণ যারা এদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। তারা রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম এর আহলে বাইতদেরকে হত্যা ও কয়েদি করেছিল। তাছাড়া তারা মদিনা শরীফ ও মক্কা শরীফের বুযুর্গ আনসার ও মুহাজিরদেরকে হত্যা করেছিল। (আত তাযকিরাহ- ২/৬৪৩ পৃষ্ঠা)
উমর বিন আব্দুল আযিয এর বক্তব্যঃ- উমর বিন আব্দুল আযিয (রাঃ) কে উমরে সানী বা দ্বিতীয় উমর বলা হয়। এজিদকে আমিরুল মোমিনীন বলায় তিনি এক ব্যক্তিকে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিয়েছিলেন। (তিনি তার কর্মকান্ডে নারাজ ছিলেন)
নওফেল বিন আবিল ফুরাত বর্ণনা করেন- একবার আমি উমর বিন আব্দুল আযিয রাদিয়াল্লাহু আনহু এর দরবারে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি ঘটনাক্রমে ইয়াজিদ সম্বন্ধে বলল ‘আমিরুল মোমেনীন এজিদ বিন মুয়াবিয়া’ একথা বলেছেন। তখন উমর বিন আব্দুল আযিয বললেন,তুমি ইয়াজিদকে আমিরুল মোমিনীন বললে? একথা বলার জন্য তিনি লোকটাকে ২০টি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ করলেন। (তারিখুল খোলাফা- ১৬৬, আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ, ৫৯৫ পৃষ্ঠা)
শেষকথা:– পরিশেষে বলতে চাই এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হল যে, এজিদই ছিল কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার মূল নায়ক। তার হুকুমেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সেই পবিত্র মস্তক মোবারকে লাঠি দ্বারা আঘাত করে উল্লাস করেছে। তার হুকুমেই মদিন শরীফে সন্ত্রাস হয়েছে। তার নির্দেশেই কাবা শরীফে হামলা হয়েছে। অথচ আজকে এ সমস্ত শেখেরা স্বীয় প্রেমিককে ভাল মানুষ সাজাতে গিয়ে মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। রচিত করছে জাল হাদিস। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে এ সমস্ত এজিদ প্রেমিদের চক্রান্ত থেকে হেফাজত করেন এবং আহলে বাইতের মহব্বত দ্বারা আমাদের অন্তরকে ভরপুর করেন। আমিন।