নাফস্ কন্ট্রোল (আত্মসংযম)
পৃথিবীতে মনে হয় এমন কোন মানুষ নেই যার মনের সাথে এ যুদ্ধটা হয় না। হোক না সেটা কোন ক্ষুদ্র ক্ষেত্রে। শয়তানের এমন ওয়াশওয়াশার স্বীকার হতে হয় না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। শয়তান থাকে মানুষের অন্তরে। দূর্বল ঈমানের মানুষের অন্তরে শক্ত আসন গেঁড়ে বসে। সর্বক্ষণ মানুষকে বিভিন্ন নিষিদ্ধ কাজে উদ্ধুদ্ধ করণের জন্য ওয়াশওয়াশা দিতে থাকে। দূর্বল মন মাঝে মাঝে শয়তানের মোকাবিলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা করবো.. কি করবো না..? যাবো.. কি যাবো না..?
.
যে মানুষটি কঠিন ঈমানদার শুধু তার দ্বারাই সম্ভব হয় নাফসের সাথে যুদ্ধ করে শয়তানকে পরাজিত করতে পারা। মাঝে মাঝে অনেক ঈমানদার মানুষ ও শয়তানের কাছে সাময়িক পরাজিত হয়।
.
ধরুন আপনি সঠিক ভাবে দ্বীন পালনের চেষ্টা করছেন। বোনটি সমস্ত ফরয ইবাদত করছেন, নন মাহরাম থেকে পরিপূর্ণ পর্দা করছেন। আবার ভাইটি ও যৌবনেই ফরয ইবাদতের পাশাপাশি দাঁড়ি রেখেছেন, টাখনুর উপরে প্যান্ট ও পরছেন। সমস্ত কিছু মেনে চলার জন্য উভয়ই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দেখুন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের আশেপাশের মানুষ দ্বারাই শয়তান কিভাবে আমাদের উপর তার শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করে। আবার কখনো হয়তো আমরা নিজেরাই নিজের নাফস্ বা প্রবৃত্তির কাছে পরাজিত হয়ে শয়তানের কাছে নিজের কালবকে সমর্পণ করি।
.
.
❒ এক.
______
.
হয়তো কোন শপিং কমপ্লেক্সে গেলেন, বা যেকোন প্রোগ্রামে। আপনার সাথে আপনার রিলেটিভ বা ফ্রেন্ড আছে। সালাতের টাইম হয়ে গেলো। আপনি উদগ্রীব হয়ে গেলেন সালাতের প্লেস খুঁজে সালাত পড়ার জন্য। কিন্তু আপনার সঙ্গীটি আপনাকে বারবার নিরুৎসাহিত করছে সালাত পড়ার ব্যাপারে। আরে দূর..! বাসায় গিয়ে কাযা পড়ে নিও। খামোখা এখন সময় নষ্ট। শপিং তো করাই হয়নি এখনও। জায়গা খুঁজে নিবে, তারপর সালাত পড়বে। কত্ত টাইম..! এই টাইমে তো আমরা শপিং টা ঠিকমতো সেরে ফেলতে পারবো।
.
ঠিক এ টাইমটাতেই আপনাকে স্ট্রং হতে হবে, যথেষ্ট স্ট্রং। আপনার ঈমানের মজবুত ভিত কারো কথায়, কারো প্রভাবে যেন বিন্দুমাত্র টলোমলো না হয়। আপনাকে মনে করতে হবে শয়তান এখন আপনার সঙ্গীর উপর ভর করেছে আপনাকে আক্রমণ করার জন্য। আপনি তার কথায় প্রভাবিত হবেন না। আপনি তার কথায় হারবেন না। বরং আপনাকে অতি অবশ্যই তার উপর জয়ী হয়ে সালাত আদায় করতেই হবে। আপনার রাব্ব আপনাকে মিটিং এ ডাকছে। পৃথিবীর যাবতীয় ইমার্জেন্সি কাজ তুচ্ছ করে আপনাকে আপনার রাব্বের মিটিং এ এটেন্ড করতেই হবে। কারণ একটা মিটিং এ যেটা আপনার জন্য অ্যাস্টিম্যাট আছে, পরের মিটিং এ কখনোই সেটা পাওয়ার আশা করবেন না। আর নেক্সট মিটিং এ যে আপনি এটেন্ড করতে পারবেন সে গ্যারান্টি আপনাকে কে দিলো…?
.
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন – “অতএব তোমরা সালাত কায়েম কর, নিশ্চয়ই সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।” (১)
.
রাসূল ﷺ বলেছেন – “কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম বান্দার সালাতের হিসাব হবে। যদি তার সালাত ঠিক হয় তবে তার সব আমলই ঠিক হবে। আর তার সালাত বিনষ্ট হলে, সব আমলই বিনষ্ট হবে।” (২)
.
তো আপনাকে যখনই সালাতের ওয়াক্ত হবে, ঠিক তখনই পড়তে হবে। শরীয়ত সম্মত কোন কারণ ছাড়া সালাতের কোন কাযাই হবে না। তাছাড়া প্রথম ওয়াক্তের সালাত আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়।
.
অথবা ধরুন শীতের ভোররাতে আপনার মোটেও ইচ্ছে করছে না এত আরামের ঘুম হারাম করে ওঠে অযু করতে, সালাত পড়তে। বা ধরুন ঘুমটা এই মাত্র এলো, সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখা ও হয়তো শুরু করলেন। কিন্তু এলার্মের তীক্ষ্ণ সাউন্ডে ঘুমটা ভেঙে গেলো। হাত চলে যাচ্ছে এলার্মটা বন্ধ করতে, সুন্দর স্বপ্নটিতে ফিরে যেতে। ঠিক এই টাইম, এই টাইমটাতেই নাফস্ কে কঠোর ভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে। কষ্ট করে বসে পড়ুন। ঘুম থেকে জেগে ওঠার দুআটি পড়ে নিন। আস্তে আস্তে ওয়াশরুমে চলে যান। চোখে পানি দিয়ে ঘুমটা তাড়ান। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্য সবকিছু।
.
যত কষ্ট করবেন ইবাদতের জন্য, যত বেশি আরামকে স্যাক্রিফাইস করবেন আল্লাহর জন্য, ততো বেশি আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারবেন ইন শা আল্লাহ্।
.
.
❒ দুই.
______
.
আপনি সুন্দর সঠিকভাবেই পর্দা করছেন, কিন্তু আপনার রিলেটিভ বা কোন ফ্রেন্ডের বিয়েতে অন্য সবাই খুব সুন্দর সাজগোজ করে এসেছে। আপনাকে ও খুব চাপাচাপি করছে। আরে দূর! বুড়ির মতো থাকিস কেন সবসময়..? একদিন একটু সাজলে কিচ্ছু হবে না। একদিনই তো! পর্দা করার যথেষ্ট টাইম পাওয়া যাবে। এত কম বয়সে কড়া নিয়ম মেনে বুড়ি সাজার কোনই প্রয়োজন নেই। অথচ পর্দা করার ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশ দেখুন,
.
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।” (৩)
.
আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য এক্ষেত্রে ও আপনাকে যথেষ্ট স্ট্রিক্ট থাকতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিতে হবে আপনার ঈমান আপনার নাফসের উপর হেরে যেতে পারে না, কক্ষনো না। ওদেরকে খুশি করা, ওদের আবদারে হেরে গেলে হবে না। সুন্দর না লাগুক! আপনার সৌন্দর্য দেখার অধিকার তো শুধু মাত্র আপনার মাহরামদের। অন্যদের কেন আপনি আপনার সৌন্দর্য দেখিয়ে বেড়াবেন..? কারণ আপনাকে খুশি করতে হবে একমাত্র আপনার রাব্বকে। কখনোই কোন মানুষকে নয়।
.
.
❒ তিন.
______
.
আপনি কোন নন মাহরামের সাথে কথা বলেন না। কিন্তু কোন প্রোগ্রামে বা ভার্সিটিতে কোনদিন কোন ফ্রেন্ডের বা কাজিনের সংস্পর্শে এসে বা ওদের চাপাচাপিতে কোন নন মাহরামের সাথে কথা বলে ফেলেছেন..! বলেই কিন্তু নিজের ভেতর অনুশোচনা সৃষ্টি হয়েছে। ইস্ কেন বললাম! কেন বললাম! গুনাহ্ হয়ে গেলো!
.
বাসায় যাওয়ার পর একাকী নির্জনে বা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ঠিকই সেই ছেলেটি বা মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেলো। বাহ্ দারুণ স্মার্ট তো মেয়েটি..! কি মায়াবী মিষ্টি চেহারা..! কথাটুকু ও..! আবার পর্দা ও করে.! এমন মেয়েকেই তো লাইফ পার্টনার হিসেবে প্রয়োজন।
.
কি হ্যান্ডসাম ছেলেটি..! এট্রাকট্রিভ পার্সোনালিটি..! ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িতে এক্কেবারে প্রিন্সলুক! এমন ছেলেকে জীবনে পেলেই তো জীবনটা পরিপূর্ণ হবে..!
.
দ্বীন কঠোরভাবে পালন করার চেষ্টা করছেন ঠিক আছে। তার মানে এই না যে আপনি কোন এলিয়েন ! আপনার ভেতরে কোন ইমোশন নেই, কোন ভালো লাগার ফিলিংস কাজ করে না। অপজিট জেন্ডারের প্রতি আকর্ষণের হরমোনজনিত এ ব্যাপারটা তো সেই টীনএইজ টাইম থেকেই শুরু হয়। কেউই এর ব্যতিক্রম নয়।
.
হয়তো দুজনেরই ইচ্ছে করবে দুজনের সেল নাম্বার নিতে, ফেসবুকে অ্যাড করতে। কিন্তু না…, ভুলে ও এই কাজটি করতে যাবেন না। ফেসবুক আইডিতে কোন নন মাহরামকে এড করবেন না, ম্যাসেঞ্জার এ না, কোন মাধ্যমেই না। সেল নাম্বার নেয়ার কথা মন থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলবেন। যে নন মাহরাম সে তো হারামই। পৃথিবীশুদ্ধ লোক এটা করেছে, ঐ ফ্রেন্ড করেছে, সেই ফ্রেন্ড করেছে। একটু কথা বললে আর কি হবে.! অ্যাড করলেই কি হবে..! মন থেকে শয়তান এরকম হাজার ও যুক্তি দাঁড় করাতে পারে। কিন্তু ভুলে ও আপনি শয়তানের ওয়াশওয়াশায় পরাজিত হবেন না। হয়তো সেটা হতে পারে আপনার জন্য খাল কেটে কুমির আনা।” এ সময় নাফস্ কে কন্ট্রোল করাটা হবে আপনার জন্য হবে মোটামুটি একটা যুদ্ধে জয়ী হবার মতো।
.
কারণ বিয়ে বহির্ভূত কোন সম্পর্কই হালাল নয়। বন্ধুর আবরণে সেটা একটা হারাম সম্পর্ক। কথা বলতে বলতে বা ফেসবুকে ওর বিভিন্ন পোস্টে এক্টিভিটি দেখাতে দেখাতে কখন যে ভালো লেগে যাবে..! কখন যে কত শত স্বপ্ন দেখা শুরু করবেন, কখন যে মনে মনে কল্পনার কত ফানুস ওড়াতে শুরু করবেন সেটা টেরই পাবেন না।
.
নন মাহরাম কাউকে নিয়ে কিছু ভাবা, কল্পনা করা ও হারাম। আপনি এ ধরনের চিন্তা এলেই কোন ইসলামী বই পড়া শুরু করবেন। কোন রিসাইটেশন বা লেকচার শোনা শুরু করবেন। মানে যেকোন ভাবেই মনকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করবেন কোন হারাম চিন্তা ভাবনা থেকে। আপনাকে এ সময়টাতে ভাবতে হবে আপনি কোন তেজী ঘোড়ায় আছেন। ঘোড়াটি আপনাকে নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে যেকোন ঝামেলায় ফেলতে পারে। সেজন্য সুকৌশলে বা সযতনে আপনাকে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতেই হবে, নাফসের পাগলা ঘোড়াকে আপনার কন্ট্রোলে আনতেই হবে।
.
কেননা আপনার জন্য তো সে-ই অপেক্ষা করছে যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আপনারই অর্ধাঙ্গী, অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে।
.
দেখুন কি সুন্দর ভাবেই বলা আছে,
.
“তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (৪)
.
মনে রাখবেন আপনার মনের ভালো লাগার বিরুদ্ধে এ সেক্রিফাইস তো শুধুমাত্র আপনার রাব্বের সন্তুষ্টির জন্য। হয়তো এজন্য মন কিছুটা বিষন্ন হবে, চোখ কিছুটা অশ্রুসজল হবে..! কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি আপনাকে এমন কিছু দেবেন যা আপনি কল্পনা ও করতে পারবেন না ইন শা আল্লাহ্…
.
.
❒ ফুটনোটঃ
___________
.
[১] সূরাহ আন-নিসা, আয়াত : ১০৩।
[২] তিরমিজি, হাদিস নং ২৭৮।
[৩] সূরাহ আন-নূর, আয়াত : ৩১।
[৪] সূরাহ আর-রুম, আয়াত : ২১।
সবাই শেয়ার করে অন্যদের জানিয়ে দিন