রোযার জন্যও এমনিভাবে নিয়্যত করা পূর্বশর্ত যেভাবে নামায ও যাকাত ইত্যাদির জন্য পূর্বশর্ত। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একেবারে পানাহার বর্জন করে থাকে, তবে তাদের রোযা হবে না। (রদ্দুল মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩১)
রমযান শরীফের রোযা হোক কিংবা নফল অথবা নির্দিষ্ট কোন মান্নতের রোযা অর্থাৎ আল্লাহর জন্য কোন নির্দিষ্ট দিনের রোযার মান্নত করে, যেমন নিজের কানে শুনতে পায় এমন আওয়াজে বলে, “আমার উপর এ বছর আল্লাহ তাআলার জন্য রবিউন নূর (রবিউল আউয়াল) শরীফের প্রত্যেক সোমবারের রোযা ওয়াজিব।” তখন এটা ‘নির্ধারিত মান্নত’ হলো। আর এ মান্নত পূরণ করা ওয়াজিব হয়ে গেলো। এ তিন ধরণের রোযার জন্য সূর্যাস্ত থেকে পরদিন ‘শরীয়তসম্মত অর্ধ দিবস’ (যাকে দ্বাহওয়ায়ে কুবরা বলা হয়) এর পূর্ব পর্যন্ত সময়-সীমার মধ্যে নিয়ত করে নিলে রোযা হয়ে যাবে।
১. রমযানের রোযা ও ‘নির্ধারিত মান্নত ও নফল রোযার জন্য নিয়্যতের সময়সীমা হচ্ছে- সূর্যাস্তের পর থেকে পরদিন ‘দ্বাহওয়ায়ে কুবরা’ অর্থাৎ ‘শরীয়ত সম্মত অর্ধ দিবস’ এর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। এ পূর্ণ-সময়ের মধ্যে আপনি যখনই নিয়্যত করে নেবেন, এ রোযাগুলো বিশুদ্ধ হয়ে যাবে।(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩২)
২. ‘নিয়্যত’ মনের ইচ্ছার নাম। মুখে বলা পূর্বশর্ত নয়। কিন্তু মুখে বলা মুস্তাহাব। যদি রাতে রমযানের রোযার নিয়্যত করবেন, তাহলে এভাবে বলবেন:
ﻧَﻮَﻳْﺖُ ﺍَﻥْ ﺍَﺻُﻮْﻡَ ﻏَﺪًﺍ ﻟِﻠّٰﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻣِﻦْ ﻓَﺮْﺽِ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥْ
অর্থাৎ- আমি নিয়্যত করলাম, আল্লাহ তাআলার জন্য কাল এ রমযানের ফরয রোযা রাখবো।
৩. যদি দিনের বেলায় নিয়্যত করেন তাহলে এভাবে বলবেন:
ﻧَﻮَﻳْﺖُ ﺍَﻥْ ﺍَﺻُﻮْﻡَ ﻫٰﺬﺍ ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﻟِﻠّٰﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻣِﻦْ ﻓَﺮْﺽِ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥْ
অর্থাৎ-আমি আল্লাহ তা‘আলার জন্য আজ রমযানের ফরয রোযা রাখার নিয়্যত করলাম। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩২)
৪. আরবীতে নিয়্যতের বাক্যগুলো দ্বারা নিয়্যত করলে তা নিয়্যত বলে তখনই গণ্য হবে, যখন সেগুলোর অর্থও জানা থাকে। আর একথাও স্মরণ রাখবেন যে, মুখে নিয়্যত করা চাই, যে কোন ভাষায় হোক, এটা তখনই কাজে আসবে, যখন অন্তরেরও নিয়্যত উপস্থিত থাকে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩২)
৫. নিয়্যত নিজের মাতৃভাষায়ও করা যেতে পারে। আরবী কিংবা অন্য কোন ভাষায় নিয়্যত করার সময় অন্তরে ইচ্ছা থাকতে হবে। অন্যথায় খামখেয়ালীবশতঃ শুধু মুখে বাক্যগুলো বললে নিয়্যত বিশুদ্ধ হবে না। হ্যাঁ মনে করুন! যদি মুখে নিয়্যতের বাক্যগুলো বললেন কিন্তু পরবর্তীতে নিয়্যতের জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অন্তরেও নিয়্যত করে নিয়েছেন, তাহলে এখন নিয়্যত শুদ্ধ হলো।(রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৩২)
৬. যদি দিনের বেলায় নিয়্যত করলেন, তবে জরুরী হচ্ছে এ নিয়্যত করবে যে, ‘আমি ভোর থেকে রোযাদার’। যদি এভাবে নিয়্যত করেন, ‘আমি এখন থেকে রোযাদার, ভোর থেকে নয় তাহলে রোযা হবে না।” (আল জাওহারাতুনড়বাইয়েরাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৫)
৭. দিনের বেলায় কৃত ওই নিয়্যতই বিশুদ্ধ, যাতে এটা থাকে যে, “সুবহে সাদিক থেকে নিয়্যত করার সময় পর্যন্ত রোযা ভঙ্গ করে এমন কোন কাজ পাওয়া না যায়।” অবশ্যই যদি সুবহে সাদিকের পর ভুলবশতঃ পানাহার করে বসেছে কিংবা স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছে, তবুও নিয়্যত বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ, ভুলবশতঃ যদি কেউ তৃপ্তি সহকারে পানাহারও করে, তবুও রোযা ভঙ্গ হয় না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৬৭)
৮. আপনি যদি এভাবে নিয়্যত করে নেন, “আগামীকাল কোথাও দাওয়াত থাকলে রোযা রাখবো না। অন্যথায় রোযা রাখবো।” এ নিয়্যতও বিশুদ্ধ নয়। মোটকথা এমতাবস্থায় আপনি রোযাদার হলেন না।(আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-১৯৫)
৯. মাহে রমযানের দিনে রোযার নিয়্যত করলেন না, এমনও না যে, আপনি রোযাদার না, যদিও জানা আছে যে, এটা বরকতময় রমযানের মাস। তাহলে রোযা হবে না। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-১৯৫)
১০. সূর্যাস্তের পর থেকে আরম্ভ করে রাতের কোন এক সময়ে নিয়্যত করলেন। এরপর আবার রাতের বেলায় পানাহার করলেন, তাহলে নিয়্যত ভঙ্গ হয়নি। ওই প্রথম নিয়্যতই যথেষ্ট, নতুনভাবে নিয়্যত করা জরুরী না। (আল জাওহারাতুল নাইয়েরাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৫)
১১. আপনি রাতে রোযার নিয়্যত তো করে নিলেন, অতঃপর রাতেই পাকাপাকি ইচ্ছা করে নিলেন যে, রোযা রাখবেন না, তাহলে আপনার পূর্ববর্তী নিয়্যত ভঙ্গ হয়ে গেছে। যদি নতুনভাবে নিয়্যত না করেন, আর দিনভর রোযাদারদের মতো ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত রয়ে গেলেন, তবুও রোযা হবে না। (রদ্দুল মুহতার সম্বলিত দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৪৫)
১২. নামাযের মধ্যভাগে কথা বলার নিয়্যত (বা ইচ্ছা) করলেন, কিন্তু কথাবার্তা বলেন নি, তাহলে নামায ভঙ্গ হয়নি। এভাবে রোযা পালনকালে রোযা ভঙ্গ করার শুধু নিয়্যত করে নিলে রোযা ভঙ্গ হয়না, যতক্ষণ না রোযা ভঙ্গকারী কোন কাজ করে নেবেন। (আল জাওহারাতুনড়বাইয়েরা, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৫) অর্থাৎ শুধু এ নিয়্যত করে নিয়েছেন, ‘ব্যাস! এক্ষুনি আমি রোযা ভঙ্গ করে নিচ্ছি। তাহলে এভাবে ততক্ষণ পর্যন্ত রোযা ভঙ্গ হবে না, যতক্ষণ না কণ্ঠনালী ভেদ করে কোন জিনিস নিচের দিকে নামানো হয়, কিংবা না এমন কোন কাজ করবে, যার কারণে রোযা ভেঙ্গে যায়।
১৩. সাহারী খাওয়াও নিয়্যতের শামিল, চাই রমযানের রোযার জন্য হোক, চাই অন্য কোন রোযার জন্য হোক। অবশ্য, সাহারী খাওয়ার সময় যদি এ ইচ্ছা থাকে যে, ভোরে রোযা রাখবে না, তবে এ সাহারী খাওয়া নিয়্যত নয়। (আল জাওহারাতুন নাইয়েরাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৭৬)
১৪. রমযানুল মুবারকের প্রতিটি রোযার জন্য নতুন করে নিয়্যত করা জরুরী। প্রথম তারিখে কিংবা অন্য কোন তারিখে যদি পূর্ণ রমযান মাসের রোযার নিয়্যতও করে নেয়া হয়, তবুও এ নিয়্যত শুধু ওই এক দিনের জন্য নিয়্যত হিসেবে গণ্য হবে; অবশিষ্ট দিন গুলোর জন্য হবে না। (আল-জাওয়াহারাতুন নাইয়েরাহ, খন্ড-১ম, পৃ-১৬৭)
১৫. রমযান, ‘নির্ধারিত মান্নত’ এবং নফল রোযা পালন ব্যতীত অবশিষ্ট রোযাগুলো, যেমন, রমযানের রোযার কাযা, অনির্ধারিত মান্নত ও নফল রোযার কাযা (অর্থাৎ নফলী রোযা রেখে ভঙ্গ করে ফেললে সেটার কাযা) আর নির্ধারিত মান্নতের রোযার কাযা ও কাফফারার রোযা এবং হজ্জে ‘তামাত্তু’ * এর রোযা-এ সব ক্ষেত্রে সুবহে সাদিকের আলো চমকিত হবার সময় কিংবা রাতে নিয়্যত করা জরুরী। আর এটাও জরুরী যে, যেই রোযা রাখবে বিশেষ করে ওই রোযারই নিয়্যত করবে। যদি ওই রোযাগুলোর নিয়্যত দিনের বেলায় (অর্থাৎ সুবহে সাদিকথেকে আরম্ভ করে ‘দ্বাহওয়া-ই- কুবরার’ পূর্বক্ষণ পর্যন্ত) করে নেয়, তবে নফল হলো। তবুও সেগুলো পূরণ করা জরুরী। ভঙ্গ করলে কাযা ওয়াজিব হবে। যদিও একথা আপনার জানা থাকে যে, আপনার যেই রোযা রাখার ইচ্ছা ছিলো এটা ওই রোযা নয়, বরং নফলই। (দুররে মুখতার সম্বলিত রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৪৪)
* হজ্জ তিন প্রকার: (১) ক্বিরান, (২) তামাত্তু, (৩) ইফরাদ। হজ্জে কিরান ও তামাত্তু করার পর শোকরিয়া স্বরূপ হজ্জের কোরবানী করা ওয়াজিব; কিন্তু ইফরাদকারীর জন্য মুস্তাহাব। যদি ক্বিরান ও তামাত্তুকারী খুব বেশী মিসকীন ও অভাবী হয়, কিস্তু কিরান বা তামাত্তুর নিয়্যত করে নিয়েছে, এখন তার নিকট কোরবানীর উপযোগী পশুও নেই, টাকাও নেই এবং এমন কোন সামগ্রীও নেই, যা বিক্রি করে কোরবানীর ব্যবস্থা করতে পারে, এমতাবস্থায় কোরবানীর পরিবর্তে দশটা রোযা রাখা ওয়াজিব হবে, তিনটা রোযা হজ্জের মাসগুলোতে, অর্থাৎ ১ম সাওয়াল-ই-মুকাররাম থেকে ৯ই যিলহজ্জ পর্যন্ত ইহরাম বাঁধার পর ওই হজ্জে যখনই চায়, রেখে দেবে। ধারাবাহিকভাবে রাখা জরুরী নয়। মাঝখানে বাদ দিয়েও রাখতে পারে। এতে ৭, ৮, ও ৯ ই যিলহজ্জ রাখা ভালো। তারপর ১৩ই যিলহজ্জের পর অবশিষ্ট ৭টা রোযা যখনই চায় রাখতে পারে। ঘরে ফিরে গিয়ে রাখাই উত্তম।
১৬. আপনি এটা মনে করে রোযা রাখলেন যে, আপনার দায়িত্বে রোযার কাযা রয়েছে, এখন রেখে দেয়ার পর জানতে পারলেন যে, ধারণা ভুল ছিলো। যদি তাৎক্ষণিকভাবে ভঙ্গ করে নেন, তবে কোন ক্ষতি নেই। অবশ্য উত্তম হচ্ছে পূর্ণ করে নেয়া, যদি জানতে পারার পর তাৎক্ষণিকভাবে ভঙ্গ না করেন, তবে এখন রোযা অপরিহার্য হয়ে গেলো। সেটা ভঙ্গ করতে পারবেন না। যদি ভঙ্গ করেন তবে কাযা ওয়াজিব হবে। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৪৬)
১৭. রাতে আপনি কাযা রোযার নিয়্যত করলেন। এখন ভোর আরম্ভ হয়ে যাবার পর সেটাকে নফল রোযা হিসেবে রাখতে চাইলে রাখতে পারবেন না। (রদ্দুল মুহতার সম্বলিত দুররে মুখতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৪৫)
১৮. নামাযের মধ্যভাগেও যদি রোযার নিয়্যত করেন; তবে এ নিয়্যত বিশুদ্ধ।(দুররে মুখতার , রদ্দুল মুহতার, খন্ড-৩য়, পৃ-৩৪৫)
১৯. কয়েকটা রোযা কাযা হয়ে গেলে নিয়্যতের মধ্যে এটা থাকা চাই’ এ রমযানের প্রথম রোযার কাযা, দ্বিতীয় রোযার কাযা।’ আর যদি কিছু এ বছরের কাযা হয়ে যায়, কিছু পূর্ববর্তী বছরের বাকী থাকে, তবে এ নিয়্যত এভাবে হওয়া চাই’ এ রমযানের কাযা, ওই রমযানের কাযা।’ আর যদি দিন নির্ধারণ না করেন, তবুও বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-১৯৬)
২০. আল্লাহর আশ্রয়! আপনি রমযানের রোযা ইচ্ছাকৃতভাবে (অর্থাৎ জেনে বুঝে) ভেঙ্গে ফেলেছেন। এমতাবস্থায় আপনার উপর ওই রোযার কাযা এবং (যদি কাফফারার শর্তাবলী পাওয়া যায়) কাফফারার ষাটটা (৬০) রোযাও। এখন আপনি একষট্টিটা (৬১) রোযা রেখে দিলেন। কাযার দিন নির্দিষ্ট করলেন না। এমতাবস্থায় কাযা ও কাফফারার উভয়টি সম্পন্ন হয়ে যাবে। (আলমগীরী, খন্ড-১ম, পৃ-১৯৬)