বিচার নেই
বাদশাহ’র কঠিন অসুখ । সারাদিন তিনি বিছানায় শুয়ে থাকেন। শরীর দুর্বল
হয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হচ্ছে। মনে কোনাে সুখ নেই। কাজকর্ম করতে
পারেন না।
বেঁচে থাকার আর কোনাে আশা নেই তার। বাদশাহ বুঝলেন, মৃত্যু তাঁর
দুয়ারে এসে হানা দিয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসকরা এল। নানারকমের
ওষুধ দিল । কিন্তু কিছুতেই কোনাে উপকার হয় না।
সকলেই খুব চিন্তিত।
চিকিৎসক এলেন ইরান-তুরান থেকে । চিকিৎসক এলেন কাবুল-কান্দাহার
থেকে। শেষে এক চিকিৎসক এলেন গ্রিস থেকে।
গ্রিসের চিকিৎসক বেশ কয়েকদিন ধরে সবধরনের পরীক্ষা করলেন
বাদশাহকে। নাড়ি টিপে দেখলেন। শরীরের তাপ নিলেন।
তারপর তিনি বললেন, এ বড় কঠিন অসুখ। তবে এর চিকিৎসা আছে।
একজন অল্পবয়স্ক বালক প্রয়ােজন, যার হৃৎপিণ্ড থেকে ওষুধ তৈরি করতে হবে।
সেই ওষুধে বাদশাহ সুস্থ হয়ে উঠবেন।
বাদশাহ’র অসুখ ।
প্রয়ােজন অল্পবয়স্ক বালক । দিকে দিকে লােক ছড়িয়ে
পড়ল। খুঁজতে খুঁজতে একটা ছেলেকে পাওয়াও গেল । ছেলের বাবা টাকার
বিনিময়ে খুব অনায়াসে ছেলেটিকে বিক্রি করে দিল বাদশাহ’র লােকদের
কাছে। টাকাও পেল বিপুল পরিমাণ।
আর কাজি বিচারসভায় রায় দিলেন, এই ছেলের জীবন বধ করা অন্যায়
কোনাে কাজ নয়। কারণ, এই ছেলের তুচ্ছ জীবনের বিনিময়ে বাদশাহ’র
মূল্যবান জীবন রক্ষা পাবে।
| ছেলেটি এইসব ঘটনা দেখে সারাক্ষণ মিটিমিটি হাসে। জল্লাদ তাকে
হত্যা করার জন্যে ধরে-বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমিতে । তার হৃৎপিণ্ড থেকে
তৈরি হবে ওষুধ। ছেলেটি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে হাে হাে করে
হাসতে লাগল।
বাদশাহ পেছনে ছিলেন। ছেলেটির হাসির শব্দ শুনে তিনি খুব বিচলিত
হলেন।
একটু পরেই তার মৃত্যু হবে! মাটিতে লুটিয়ে পড়বে তার
সুন্দর দেহ। তবে ছেলেটি প্রাণ খুলে হাসে কেন? বাদশাহ তাকে
ডেকে পাঠালেন।
—তুমি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে এরকম ভাবে হাসছ কেন?
ছেলেটি হাসতে হাসতেই বলল-হায়, আমার জীবন! আমি হাসব-না
তাে কে হাসবে বলুন? পিতামাতার দায়িত্ব সন্তানদের রক্ষা করা। কিন্তু
দেখুন, কিছু অর্থের বিনিময়ে আমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন ।
কাজির দরবারে মানুষ যায় কেন? সুবিচারের আশা নিয়ে।
কিন্তু, কাজি সাহেব অন্যায়ভাবে বাদশাহ’র পক্ষ নিলেন। আমাকে হত্যা করার
হুকুম দিলেন তিনি। আর বাদশাহ’র কর্তব্য কী? বাদশাহ তাে
গরিব-দুঃখী, অত্যাচারিত, নিপীড়িত প্রজাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু এখন
কী ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে? বাদশাহ নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য
অন্যের জীবনকে তুচ্ছ করছেন। কিন্তু অপরের জীবনও যে তার নিজের
কাছে অতি মূল্যবান—এই সামান্য কথা তিনি মনেই রাখলেন না।
হায়! একটু পরেই আমার মৃত্যু হবে। আমি হাসব-না তাে কে হাসবে!
জগৎ-সংসারের এইসব খেলা দেখে একমাত্র আমিই এখন প্রাণ খুলে
হাসতে পারি।
বাদশাহ এই কথা শুনে অবাক হলেন। ছেলেটির প্রতি অসীম মমতায়
তিনি কাতর হয়ে উঠলেন। তিনি ছেলেটিকে মুক্ত করে দিলেন।
আর আশ্চর্যের ব্যাপার
তার কিছুদিন পরেই বাদশাহ’র অসুখ সেরে গেল। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ
হয়ে উঠলেন।