হিজড়া কাকে বলে?
প্রশ্ন:- মুখান্নাস (হিজড়া) কাকে বলে?
উত্তর:- “মুখান্নাস” এটা আরবী ভাষার শব্দ। যার অর্থ সেই পুরুষ যার চাল চলন ও ভাবভঙ্গি মহিলাদের মতো নরম ও নমনীয় হয়। (মুস্তাফাঁদ আয আলবাহরুর রাইক্ব, ৯ম খন্ড, ৩৩৪ পৃষ্ঠা)
মুসলিম শরীফের ব্যাখাকারী আল্লামা নববী ﺭَﺣْﻤَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻠَﻴْﻪِ বলেন: “মুখান্নাস তাকে বলে, যার রীতিনীতি, আচার আচরণ, কথা বার্তা, চাল চলন ও সক্ষমতায় মহিলাদের সাদৃশ্য হয়। অর্থাৎ তাদের ন্যায় হয়। অনেক সময় তো কারো এই ভাবভঙ্গি জন্মগত হয়ে থাকে এবং কিছু লোক নিজেই এই ভাবভঙ্গি অবলম্বন করে।” (শরহে মুসলিম লিন নববী, ২য় খন্ড, ২১৮ পৃষ্ঠা)
হিজড়ামী করা থেকে বিরত থাকার প্রতি জোরঃ
প্রশ্ন:- হিজড়ারা কি হিজড়ামী থেকে বিরত থাকবে?
উত্তর:- জ্বী, হ্যাঁ! যদি জন্মগতভাবে কারো চাল-চলন অথবা কন্ঠ ইত্যাদি মহিলাদের সাদৃশ্য হয়, তবে তার উচিত, সে যেন পুরুষ সূলভ আচরণ অবলম্বন করার জন্য চেষ্টা করে। যার আওয়াজ ও কার্যকলাপ ইত্যাদি প্রাকৃতিকভাবেই মহিলাদের ন্যায় হয়ে থাকে, এতে তার নিজের কোন দোষ নেই। আর পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করা সত্ত্বেও যদি আচার আচরণ অপরিবর্তিত থেকে যায়, তবে এতে শরয়ী কোন পাকড়াও নেই। (ফয়যুল কাদির, ৫ম খন্ড, ৩৪৬ পৃষ্ঠা। নুযহাতুল ক্বারী, ৫ম খন্ড, ৫৩৭ পৃষ্ঠা)
নকল হিজড়াঃ
প্রশ্ন:- নকল হিজড়া হওয়া কি গুনাহ?
উত্তর:- নিশ্চয় গুনাহ! যদি কেউ নিজে নিজে মহিলাদের আচার আচরণ অবলম্বন করে অর্থাৎ হিজড়া হয়ে যায় তবে সে গুনাহগার ও জাহান্নামের আগুনের হকদার হবে।
হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস ﺭَﺿِﻰَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻨْﻬُﻤْﺎ থেকে বর্ণিত; তাজদারে রিসালাত, শাহানশাহে নবুয়ত, মাহবুবে রাব্বুল ইয্যত, নবীয়ে রহমত, শফীয়ে উম্মত ﺻَﻠَّﯽ ﺍﻟﻠّٰﮧُ ﺗَﻌَﺎﻟٰﯽ ﻋَﻠَﯿْﮧِ ﻭَﺍٰﻟِﮧٖ ﻭَﺳَﻠَّﻢ পুরুষের মধ্যে মুখান্নাসদের (অর্থাৎ মহিলাদের আচার আচরণ অবলম্বনকারীদের) প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং সেই মহিলাদের প্রতি, যারা পুরুষের আচরণ অবলম্বন করে আর হুযুর ﺻَﻠَّﯽ ﺍﻟﻠّٰﮧُ ﺗَﻌَﺎﻟٰﯽ ﻋَﻠَﯿْﮧِ ﻭَﺍٰﻟِﮧٖ ﻭَﺳَﻠَّﻢ ইরশাদ করেন: “তাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দাও।” (বুখারী, ৪র্থ খন্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৬৮৩৪)হুযুর আকরাম, শাহানশাহে বণী আদম ﺻَﻠَّﯽ ﺍﻟﻠّٰﮧُ ﺗَﻌَﺎﻟٰﯽ ﻋَﻠَﯿْﮧِ ﻭَﺍٰﻟِﮧٖ ﻭَﺳَﻠَّﻢ মুখান্নাসদের (নকল হিজড়াদের) প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।
যে হিজড়া নয় তাকে হিজড়া বলে ডাকা কেমন?
প্রশ্ন:- যে হিজড়া নয় তাকে হিজড়া বলে ডাকা কেমন?
উত্তর:- এতে মুসলমানের অন্তরে কষ্ট প্রদানকারী হিসাবে গুনাহগার এবং জাহান্নামের আযাবের হকদার হবে। বরং ইসলামী আদালতে অভিযোগ করাবস্থায় ২০টি চাবুক মারার শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। সুতরাং একটি হাদীসে পাকে প্রিয় নবী ﺻَﻠَّﯽ ﺍﻟﻠّٰﮧُ ﺗَﻌَﺎﻟٰﯽ ﻋَﻠَﯿْﮧِ ﻭَﺍٰﻟِﮧٖ ﻭَﺳَﻠَّﻢ এটাও ইরশাদ করেছেন: “যদি কেউ কাউকে বলে ‘হে হিজড়া’ তবে তাকে বিশটি চাবুক মারো।” (সুনানে তিরমিযী, ৩য় খন্ড, ১৪১ পৃষ্ঠা, হাদীস: ১৪৬৭)
প্রখ্যাত মুফাস্সীর হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন ﺭَﺣْﻤَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻠَﻴْﻪِ এই হাদীসে পাকের ব্যাখ্যায় বলেন: “মুখান্নাস সেই, যার অঙ্গে কোমলতা, আওয়াজ মহিলাদের ন্যায় এবং মহিলাদের মতোই থাকে। কাউকে হিজড়া বলাতে তার অপমানবোধ হয়, যাতে সম্মানহানীর দাবী সাব্যস্ত হতে পারে এবং সেই শাস্তি (যা হাদীসে পাকে বর্ণিত রয়েছে) হতে পারে, তেমনিভাবে যদি কেউ কাউকে বলে: হে মদ্যপায়ী! হে অবিশ্বাসী! হে বলৎকারী! হে সুদখোর! হে দাইয়্যুস! হে খেয়ানতকারী! হে চোরের মা! এই সমস্ত (অপবাদ লাগানোতেও) একই শাস্তি হতে পারে।” (মিরআত, ৫ম খন্ড, ৩২৬ পৃষ্ঠা)
হিজড়াকে হিজড়া বলে সম্বোধন করাঃ
প্রশ্ন:- যে জন্মগতভাবেই হিজড়া, তাকে হিজড়া বলে সম্বোধন করা যাবে কি না?
উত্তর:- শরীয়াতের বিনা অনুমতিতে এরকম করা উচিত নয়। কেননা, এতে সে লজ্জিত হয়। অন্তরেও কষ্ট পেতে পারে। যেমনিভাবে বিনা প্রয়োজনে অন্ধকে অন্ধ বলা, খাটোকে খাটো ও লম্বাকে লম্বা বলে সম্বোধন করার শরীয়াতে অনুমতি নেই। তেমনিভাবে এখানে এভাবে (বলার অনুমতি নেই) বরং এমতাবস্থায় তো অন্তরে কষ্ট পাওয়ার অনেক বেশি সম্ভাবনা থাকে।
হিজড়াদের আচরণঃ
প্রশ্ন:- হিজড়ার আচরণ সম্পর্কে আপনি কি বলেন?
উত্তর:- আমাদের এখানে যে সমস্ত হিজড়া পাওয়া যায় তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মুখান্নাস হয়ে থাকে আর কিছু সংখ্যক তৃতীয় লিঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যাদেরকে খুনছা অথবা কঠোর খুনছা বলা হয়। তাদের মধ্যে অনেকে ভদ্র ও আল্লাহ্ ওয়ালা হয়ে থাকে। আর কিছু সংখ্যক ভিক্ষুকের পেশা গ্রহণ করে, নাচ দেখায়, ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় এবং এই অশ্লীল পদ্ধতিতে হারাম রুজি উপার্জন করে খায় এবং নিজেকে জাহান্নামের হকদার বানায়। এজন্য সাবধান! এমন লোকদেরকে কখনোও ঘরে প্রবেশ করতে দিবেন না এবং তাদের ভিক্ষা দিয়ে গুনাহে ভরা কাজে তাদের সাহায্য করবেন না। কেননা, পেশাদার ভিক্ষুককে দান করা গুনাহ।
প্রশ্ন:- অনেক সময় তো হিজড়া একেবারে উঠে পড়ে লেগে যায় এবং কিছু ছাড়া ফেরার নামই নেয় না। বিশেষ করে বিয়ে অথবা সন্তান জন্মের অনুষ্ঠান সমূহে অনেক বেশি এক গুয়েঁমী করে। আর যদি তাদেরকে কিছু দেয়া না হয়, তবে অসম্মানজনক আচরণ করে। এমন অবস্থায় কি করা যায়?
উত্তর:- যতটুকু সম্ভব তাদের থেকে পিছু ছাড়িয়ে নেয়া উচিত, আর যদি সত্যিকারেই তাদের আচরণে অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয় তবে তাদের চুপ করানোর নিয়্যতে কিছু দেওয়া, দাতার জন্য জায়েয। কেননা, হাদীসে মোবারাকা থেকে প্রমানিত যে, যদি কোন কবি কারো দুর্নাম করে কবিতা লিখার মাধ্যমে তার সম্মানহানি করে, তবে তাকে চুপ করানোর জন্য কিছু দেয়া জায়েয। যদিও বা এটা ঘুষ, কিন্তু এমতাবস্থায় ঘুষ দেওয়া জায়েয। আর গ্রহণকারীর জন্য সর্বাবস্থায় হারাম এবং জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ।
তৃতীয় লিঙ্গ তথা খুনছা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানঃ
প্রশ্ন:- মুখান্নাসের ব্যাপার তো বুঝে আসলো, তারা শারীরিক আকৃতিতে পুরুষই। কিন্তু এখন আপনি তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ খুনছা এবং কঠোর খুনছার আলোচনা করলেন, তাহলে এটাও বলে দিন যে তাদের সংজ্ঞা ও নির্দশন কি?
উত্তর:- পুরুষ ও মহিলার পাশাপাশি একটি তৃতীয় লিঙ্গও রয়েছে। ফিকহের কিতাব সমূহে তাদের সংজ্ঞা কিছুটা এরূপ করা হয়েছে: “যার মধ্যে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের লজ্জাস্থান রয়েছে তাদেরকে খুনছা বলা হয়।” (মুহিত বরহানী, ২৩তম খন্ড, ৪৫৪ পৃষ্ঠা) ফুকাহায়ে কিরামগণ ﺭَﺣْﻤَﺔُ ﺍﻟﻠﻪِ ﺗَﻌَﺎﻟٰﻰ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ খুনছার সংজ্ঞায় এটাও সংযোজন করেন যে, “অর্থাৎ তাদেরকেও খুনছা বলা হয়, যারা উভয় লজ্জাস্থান থেকে একটিরও অধিকারী নয়, বরং শুধুমাত্র সামনের দিকে একটি ছিদ্র থাকে যা দ্বারা প্রাকৃতিক কাজ সেরে নেয়।”(তাবয়িনুল হাকায়িক, ৭ম খন্ড, ৪৪০ পৃষ্ঠা। আল বাহরুর রাহকয়িক, ৯ম খন্ড, ৩৩৪ পৃষ্ঠা) “বাদায়িয়ুস সানায়ি” এর মধ্যে খুনছা সম্পর্কিত বাক্যের সারাংশ হচ্ছে: “যদি সন্তানের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের লজ্জাস্থান থাকে এবং যদি সে পুরুষালী লজ্জাস্থান দ্বারা প্রস্রাব করে তবে সে পুরুষ এবং যদি মহিলার লজ্জাস্থান দ্বারা প্রস্রাব করে তবে সে মহিলা হিসেবে গন্য হবে এবং অবশিষ্ট অঙ্গকে অতিরিক্ত বলে গন্য করা হবে। যদি উভয় লজ্জাস্থান থেকে প্রস্রাব আসে তবে যেটা দিয়ে সর্ব প্রথম বের হবে সেটাই তার আসল লজ্জাস্থান হবে। উদাহরন স্বরূপ: যদি প্রথমে মহিলার লজ্জাস্থান দিয়ে প্রস্রাব করে তবে সে মহিলা হিসেবে গন্য হবে। যদি উভয় স্থান দিয়ে একই সময় প্রস্রাব করে, তবে তার জাত নিদিষ্ট করা (অর্থাৎ সে পুরুষ নাকি মহিলা নিদিষ্ট করা) অত্যন্ত কঠিনতর আর এমন ব্যক্তিকে কঠোর খুনছা বলে। সুতরাং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর যদি পুরুষের নিদর্শন থেকে কোন নিদর্শন পাওয়া যায় যেমন; দাঁড়ি বেরিয়ে যায়, তবে শরীয়াতের বিধিবিধানের উপর আমল করার ব্যাপারে সে পুরুষ হিসেবে গন্য হবে। আর যদি মহিলা জাতীয় কোন নিদর্শন প্রকাশ পায়। যেমন; স্তন বের হয়ে যায়, তবে সে মহিলা হিসেবে গণ্য হবে এবং তার উপর মহিলার যাবতীয় মাসয়ালা বর্তাবে।” (বাদায়িয়ুস সানাই, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪১৮ পৃষ্ঠা)
আর যদি প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর শুধুমাত্র পুরুষ অথবা মহিলার নিদর্শন প্রকাশ হওয়ার পরিবর্তে উভয়ের নিদর্শন প্রকাশ পায়, যেমন: দাঁড়িও গজায় এবং স্তনও বের হয়, তবে এমতাবস্তায়ও তাকে কঠোর খুনছা হিসেবে গণ্য করা হবে। (ফতোওয়ায়ে শামী, ১০ম খন্ড, ৪৭৮ পৃষ্ঠা)