তারাভীহ্ ও ই’তিকাফের মাস’আলা মাসায়েল |Tarabih

তারাভীহ্ ও ই’তিকাফের মাস’আলা মাসায়েল

★ তারাভীহ্ঃ

* তারাভীহের ২০ রাকাত নামায প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্। জামাত সহকারে মসজিদে আদায করা উত্তম। নামাযে পূর্ণ এক খতম ক্বোরআন পড়া সুন্নাত। বেশী পড়া ভাল। ক্বদর রাত্রিতে এক খতম করা মুস্তাহাব।

ক্বোরআন খতম করলে জামাতের লোকের কষ্ট হলে বা জামাতের লোক কমে গেলে ছোট ক্বিরআত দ্বারা পড়া ভাল। কিন্তু অলসতার জন্য খতম-এ ক্বোরআন ছেড়ে দেয়াও অনুচিত।
অধিকাংশ হাফেয আজকাল খতমে ক্বোরআন আদায়ের সময় এত দ্রুত তিলাওয়াত করেন যে, শুধুমাত্র আয়াতের শেষাংশ টুকুই বোধগম্য হয়। বর্ণ ও শব্দের উচ্চারণ ওয়াজিব গুন্নাহ ও মদ্দে ওয়াজিব সঠিকভাবে আদায় করেন না এ ধরনের নামমাত্র খতমে ক্বোরআন দ্বারা ক্বোরআন খতম তো দূরের কথা, নামাযও শুদ্ধ হবে না।

* না-বালেগের পেছনে বালেগের তারাভীহ্ শুদ্ধ হবে না। অর্থাৎ তারাভীহ্ নামাযে অপ্রাপ্তবয়স্ক ইমামের পেছনে প্রাপ্তবয়স্কের ইক্বতিদা করা শুদ্ধ নয়, এটাই সহীহ।

তারাভীহের প্রতি চার রাকাত অন্তর বসে তাসবীহ ও দরূদ পাঠ করবেন এবং দু‘আ পড়বেন-

সুবহানা যিলমুলকি ওয়াল মালাকুতি সুবহানা যিল্ ইয্যাতি ওয়াল ‘আয্মাতি ওয়াল হাইবাতি ওয়াল ক্বুদরাতি ওয়াল কিবরিয়া-ই ওয়াল জাবারূত। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল লাযী লা-ইয়ানামু ওয়ালা-ইয়ামুতু আবাদান আবাদা। সুব্বুহুন ক্বুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি ওর্য়া রূহ।

এটাও বৃদ্ধি করা যায়-

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু নাস্তাগফিরুল্লাহা নাস্আলুকাল জান্নাতা ওয়া নাঊযু বিকা মিনান্ নার।

অতঃপর এটা পড়ে মুনাজাত করবেন-

আল্লাহুম্মা ইন্না-নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া না‘ঊযুবিকা মিনান্ নার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান্ নার, বিরাহমাতিকা ইয়া-আযী-যু ইয়া-গাফ্ফা-রু ইয়া-কারীমু ইয়া-সাত্তারু ইয়া-রহী-মু ইয়া-জাব্বা-রু ইয়া-খালিক্বু ইয়া-বা-র। আল্লা-হুম্মা! আজিরনা ওয়া খাল্লিসনা মিনান্ নার ইয়া-মুজী-রু ইয়া-মুজী-রু ইয়া-মুজী-রু বিরহমাতিকা ইয়া আরহামার রা-হিমীন।

* যদি কোন কারণে তারাভীহ নামায ফাসেদ (ভঙ্গ) হয়ে যায় তবে যতটুকু ক্বোরআন মজীদ ঐ নামাযে পড়া হয়েছে তা পুনরায় পড়তে হবে, যাতে খতমে ক্বোরআন পরিপূর্ণ হয়। [আলমগীরী]

* যদি কোন কারণে ক্বোরআন খতম না হয়, তবে সূরা তারাভীহ্ পড়বে। এ জন্য কেউ কেউ নিয়ম ধার্য করেছেন যে- সূরা ফীল (আলম্ তারা) থেকে সূরা নাস (ক্বুল আ‘ঊযু বিরব্বিন নাস) পর্যন্ত দুইবার পড়লে ২০ রাকাত হয়ে যাবে।

* প্রত্যেক অথবা প্রথম রাক্আতে সূরা কাওসার থেকে সূরা লাহাব পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এবং দ্বিতীয় রাক্‘আতে সূরা ইখলাস পড়বে। এর ফলে আট রাক্‘আত হবে। তাঁরপর ১ম ও ২য় রাক্‘আতে সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস পড়ে দু‘রাক্‘আত পড়লে দশ রাক্‘আত হয়। এভাবে দু’বার নামায সম্পন্ন করলে ২০ রাক্‘আত হবে। অথবা প্রত্যেক রাকাতে সূরা তাকাসুর থেকে সূরা নাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আর দ্বিতীয় রাক্‘আতে নিয়মানুসারে সূরা ইখলাস পড়েও ২০ রাক্‘আত তারাভীহ্ সম্পন্ন করা যাবে।

#ই’তিকাফঃ

ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়্যত সহকারে মসজিদে অবস্থান করাকে ইসলামী পরিভাষায় ই’তিকাফ বলে।

* ই’তিকাফকারী নারী-পুরুষের অবশ্যই মুসলমান ও বিবেকবান হওয়া পূর্বশর্ত। পুরুষকে স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি থেকে এবং নারীকে হায়য-নেফাসের অপবিত্রতা হতে পবিত্র হতে হবে।

★ ই’তিকাফের জন্য মসজিদঃ

ই’তিকাফের জন্য জামে মসজিদ হওয়া শর্ত নয়, বরঞ্চ যে মসজিদে ইমাম ও মোয়ায্যিন নিয়োজিত আছেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআত সহকারে আদায় হয়, সে সব মসজিদে ই’তিকাফ করা জায়েয। [বাহারে শরীয়ত ও তাহতাবী]

* তবে মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও মুকাদ্দাস, অতঃপর যেখানে জামাত বড় হয় সেখানে ই’তিকাফ করা ভাল। মেয়েদের জন্য মসজিদে ই’তিকাফ করা মাকরূহ। তারা ঘরে একটা নির্দিষ্ট কক্ষে ই’তিকাফ করবে। [বাহারে শরীয়ত ও তাহতাবী শরীফ]

* পবিত্র রমযান শরীফের শেষের দশদিন ই’তিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ আলাল কেফায়া অর্থাৎ মহল্লাবাসীর কেউ যদি ই’তিকাফ করে তাহলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ ই’তিকাফ না করে, তাহলে সকলেই সমানভাবে গুনাহগার হবে। [আলমগীরী, দুররে মুখতার]

* ই’তিকাফ আদায়ের জন্য ২০ রমযানের সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে ই’তিকাফের নিয়্যতে প্রবেশ করে ঈদের চাঁদ উদয় হওয়ার পর বের হবেন। কেউ যদি ২০ রমযানের সূর্যাস্তের পর মসজিদে প্রবেশ করে তবে কিছু সময় কম হওয়ার দরুন তার ই’তিকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ হিসেবে আদায় হবে না।

★ ই’তিকাফ অবস্থায় যা মাকরূহঃ

১. ই’তিকাফকারী চুপ থাকা। ইবাদত মনে করে চুপ থাকা মাকরূহে তাহরীমী (গুনাহ); তবে স্বাভাবিক কারণে চুপ থাকা মাকরূহে তাহরীমী নয়।

২. কথাবার্তা বলা বা অনর্থক কোন কাজ করা। মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তা বলা পুণ্যসমূহকে নষ্ট করে দেয়।

★ ই’তিকাফ অবস্থায় কি কি করা ভালঃ

১. পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামা‘আত সহকারে আদায় করা। জামা‘আত অকারণে ছেড়ে দিলে গুনাহগার হবে। কেননা জামা‘আত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।

২. ইশরাক, দ্বোহা, আউয়াবীন, শাফীউল বিতর ও তাহাজ্জুদ নামায আদায় করা।

৩. ক্বোরআন শরীফ তিলাওয়াত করা।

৪. হাদীস শরীফ অধ্যায়ন করা।

৫. ক্বোরআন-হাদীসের বিশুদ্ধ তাফসীর ও ব্যাখ্যাগ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করা।

৬. নবী ও ওলীগণের জীবনী পাঠ করা।

৭. ধর্মীয় পুস্তিকা পাঠ করা।

৮. অধিক পরিমাণে দরূদ শরীফ পাঠ করা।

৯. তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি পাঠ করা। অর্থাৎ সর্বদা ইবাদতে মগ্ন থাকা। [তাহতাবী ও দুররে মুখতার]

* কেউ মান্নাতের ই’তিকাফ পালনকালে মৃত্যু বরণ করলো কিংবা মৃত্যুকালে তার দায়িত্বে মান্নতের ই’তিকাফ থেকে যায়, তবে প্রতিদিনের পরিবর্তে একজনের ফিতরা পরিমাণ অর্থ বা আহার্য কোন ফক্বীর-মিসকীনকে প্রদান করতে হবে যদি মান্নতকারী ওসীয়ত করে যায়। মান্নতকারীর জন্য ওসীয়ত করে যাওয়া কর্তব্যও বটে। ওসীয়ত না করলেও ওয়ারিশগণের কেউ তা আদায় করা জায়েয ও উত্তম।

* ই’তিকাফকারী ভুল বশতঃ দিনের বেলায় কিছু খেয়ে ফেললে ই’তিকাফ নষ্ট হবে না। [ফতোয়ায়ে আলমগীরী]

* ই’তিকাফকারী প্রস্রাব-পায়খানা করতে বের হওয়া অবস্থায় কর্জদাতা তাকে আটকে ফেললে তার ই’তিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

★ ই’তিকাফ নষ্ট হওয়ার কারণসমূহঃ

১. শরীয়ত অনুমোদিত প্রয়োজন ছাড়া ই’তিকাফকৃত মসজিদ বা ঘর থেকে বের হলে।

২. স্বামী-স্ত্রী পরস্পর যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হলে।

৩. স্বামী-স্ত্রী পরস্পর চুম্বন করলে বা কামভাব নিয়ে স্পর্শ করলে।

৪. জানাযার নামায পড়তে বের হলে।

৫. রোগী দেখতে বের হলে।

৬. পাগল হয়ে গেলে বা বেহুশ থাকা অবস্থায় রোযা রাখা সম্ভব না হলে।

৭. খাবার মসজিদে নেয়া সত্ত্বেও বাইরে এসে খেলে।

৮. ওযু ও গোসলের জন্য ভেতরে ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাইরে বের হলে ই’তিকাফ ভঙ্গ হবে।

★ যেসব প্রয়োজনে ই’তিকাফের স্থান হতে বের হওয়া বৈধঃ

১. ভিতরে পায়খানা-প্রস্রাবের ব্যবস্থা না থাকলে।

২. পুরুষের জন্য ই’তিকাফ কৃত মসজিদে জুমুআর ব্যবস্থা না থাকা অবস্থায় জুমার নামায আদায়ের জন্য যাওয়া।

৩. অপবিত্র হলে গোসলের জন্য (ভেতরে ব্যবস্থা না থাকলে)। অবশ্যই, পায়খানা-প্রস্রাব করতে গিয়ে মুস্তাহাব গোসল করে ফেললে ক্ষতি নেই।

৪. খাবার আনার ব্যবস্থা না থাকলে ঘরে গিয়ে আহার করা।

৫. আযান দিতে মিনার পর্যন্ত যাওয়া।

৬. মসজিদ ভেঙ্গে পড়লে, যালিমদের অত্যাচারের আশঙ্কায় নিরাপত্তার জন্য অন্য মসজিদে গিয়ে ই’তিকাফ সম্পন্ন করা জায়েয এবং সে উপলক্ষে বের হওয়া।

মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামিন আসন্ন মাহে রমজানে আমাদের বেশি বেশি নেক আমল তৌফিক দান করুন। #আমীন।

Spread the love

Leave a Comment